Ad Code

Responsive Advertisement

রোহিঙ্গাদের রয়েছে গৌরবময় অতীত, ছিল স্বাধীন রাজ্য, রাজ্যের আদি নাম ছিল আরাকান,

পৃথিবী থেকে বিলুপ্তপ্রায় আদিগোষ্ঠীর তালিকায় ভয়াবহ অবস্থানে রয়েছে রোহিঙ্গারা, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নতুন আশার আলো

জাতিসংঘের মতে, এই গ্রহের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। আর আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা মেডিসিনস স্যান ফ্রন্টিয়ারস বলছে, পৃথিবী থেকে বিলুপ্তপ্রায় আদিগোষ্ঠীর তালিকায় ভয়াবহ অবস্থানে রয়েছে রোহিঙ্গারা। আজকের নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের রয়েছে গৌরবময় অতীত। রোহিঙ্গাদের স্বাধীন রাজ্য ছিল। রাজ্যের আদি নাম ছিল আরাকান। যেমন—মিয়ানমারের আদি নাম ছিল বার্মা। আরাকান ছিল বরাবরই স্বাধীন ও অতিশয় সমৃদ্ধ একটি দেশ। বাংলার প্রাচুর্যের কারণে যেমন এখানে ইউরোপীয়দের আগমন ঘটে, তেমনি আরাকানেও পর্তুগিজ ও ওলন্দাজদের আগমন ঘটে। ওলন্দাজরা আরাকান থেকে দাস ও চাল ক্রয় করত। আর তারা সেখানে নিয়ে আসত লোহা ও লৌহজাত সামগ্রী। আরাকানের মুসলমানরা বার্মিজ মগদের চেয়ে সুপ্রাচীন। বর্মিদের কয়েক শ বছর আগে থেকে সেখানে মুসলমানদের বসবাস। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। অন্যদিকে দশ কিংবা বারো শতকের আগে বর্মি অনুপ্রবেশ ঘটেনি। সেই হিসাবে রোহিঙ্গারা আরাকানের ভূমিপুত্র। ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের আরাকান স্বাধীন রাজ্য ছিল। ১৭৮৫ সালের প্রথম দিকে মিয়ানমারের রাজা ভোধাপোয়া এটি দখল করে বার্মার (মিয়ানমার) করদরাজ্যে পরিণত করেন। রাজা ভোধাপোয়া আরাকান দখল করে বার্মার সঙ্গে যুক্ত করার আগে ১৪০৪ থেকে ১৬২২ সাল পর্যন্ত ১৬ জন মুসলিম রাজা আরাকান শাসন করেন। রাজ্য হারানোর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা শুরু হয়। ভোধাপোয়া আরাকান আক্রমণ করে ভয়ংকর নৃশংসতা চালান। সে সময় দুই লক্ষাধিক আরাকানবাসীকে হত্যা করা হয়। পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়, যাতে এ জাতির পুনরুত্থানের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। ১৮২৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি বার্মা দখল করে। এরপর দীর্ঘ ১০০ বছর পর্যন্ত আরাকানিরা অনেকটা স্বস্তিতে ছিল। কিন্তু ১৯৪২ সালে আরাকান জাপানিদের অধীনে চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জাপানি সেনাদের নৃশংসতায় অনেক রোহিঙ্গা প্রাণ হারায়, রোহিঙ্গা নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়। ১৯৪৫ সালে আবার ব্রিটিশরা আরাকান দখল করে। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করার পর নতুনভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, গণধর্ষণ, নির্যাতন আর উচ্ছেদে মেতে ওঠে বর্মিরা। ১৯৮২ সালে নতুন নাগরিকত্ব আইন করে ভূমিপুত্র রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের বহিরাগত আখ্যা দিয়ে রোহিঙ্গা নামে কোনো জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব মিয়ানমারে ছিল না বলে দাবি করছে। তার পরও মাতৃভূমির মায়ায় মাটি কামড়ে মিয়ানমারে বসবাস করছিল রোহিঙ্গারা। কিন্তু ২০১৭ সালে নির্যাতনের মাত্রা এতটাই ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছে যে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশ সরকার দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলাপ-আলোচনা ও দূতিয়ালির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে নানাভাবে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চুক্তি হলেও মিয়ানমারের দুর্বৃত্ত সরকারের নানা প্রতারণা ও ছলচাতুরীতে একজন রোহিঙ্গাকেও আজ পর্যন্ত ফেরত পাঠানো যায়নি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র চীন ও রাশিয়ার মনোভাবের কারণে জাতিসংঘের মাধ্যমে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে খ্যাত ভারতও স্পষ্টতই মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে। মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বাংলাদেশ সরকার ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার সহায়তায় আফ্রিকার রাষ্ট্র গাম্বিয়াকে দিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলা করিয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ছয় দফা নির্দেশনা সংবলিত অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়েছেন। মূল মামলা শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ তালিকাভুক্ত রয়েছে। গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের জন্য ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালে গৃহীত যে রোম সংবিধির আওতায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠিত হয়েছে, মিয়ানমার তার পক্ষ না হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে পারবেন কি না আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি আদালতের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসি জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তদন্ত করার কর্তৃত্ব আদালতের রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবে জাতীয় ঐক্য সরকার। তবে এরূপ স্বীকৃতি দেওয়ার আগে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের শর্ত আরোপ করতে হবে। কোনো সরকার বা রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে শর্ত যুক্ত করা আন্তর্জাতিক আইনে পুরোপুরি বৈধ। জাতীয় ঐক্য সরকারকে স্বীকৃতির আগে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে লিখিত সম্মতি বা চুক্তির একটি রূপরেখা তৈরি করা আবশ্যক। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতীয় ঐক্য সরকার সম্মত থাকলে চীন ও রাশিয়ার ভেটো কোনো বাধা হতে পারবে না। উপরন্তু গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের পথও সুগম হবে। জাতীয় ঐক্য সরকারকে স্বীকৃতি দিলে সেটি হবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পক্ষে অবস্থান নেওয়া। এই সিদ্ধান্ত সামরিক একনায়কতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে এসিড টেস্ট তারা জাতীয় সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করতে চায়, না গোপনে সামরিক সরকারের দোসর হয়ে রোহিঙ্গা সংকটকে দীর্ঘায়িত কিংবা অনির্দিষ্টকালের জন্য অমীমাংসিত রেখে নাজায়েজ ফায়দা হাসিল করতে চায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ad Code

Responsive Advertisement